বাংলাদেশে ধানের তিন ধরনের মাজরা পোকার আক্রমন দেখা যায়। যেমনঃ ১। হলুদ মাজরা পোকা ২। কালো মাথা মাজরা পোকা ৩। গোলাপী মাজরা পোকা।
এই পোকাগুলোর কীড়ার রঙ অনুযায়ী তাদের নামকরণ করা হয়েছে। এদের আকৃতি ও জীবন বৃত্তান্তে কিছুটা পার্থক্য থাকলেও ক্ষতির ধরন এবং দমন পদ্ধতি একই রকম। হলুদ মাজরা পোকা প্রধানত বেশি আক্রমণ করে বলে নিচে এই পোকার বিবরণ দেয়া হলঃ
পূর্ণবয়স্ক হলুদ মাজরা পোকা এক ধরনের মথ। পূর্ণবয়স্ক স্ত্রী পোকার পাখার উপরে দু'টো কালো ফোটা আছে। পুরুষ মথের মাঝখানে ফোটা স্পষ্ট নয়। তবে পাখার পিছন দিকে ৭-৮ টা অস্পষ্ঠ ফোঁটা আছে।
গাছে মাজরা পোকার ডিমের গাদা দেখলে বুঝতে হবে গাছের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
হলুদ মাজরা পোকার ডিমের গাদার ওপর হালকা ধূসর রঙের একটা আবরণ থাকে।
সব মাজরা পোকার মথই নিশাচর। দিনে এগুলো পাতার নিচে লুকিয়ে থাকে। কেবল রাতে অন্ধকারে এরা চলাফেরা করে। এরা সবাই আলোর দিকে আকৃষ্ট হয়।
ক্ষতির ধরণঃ
মাজরা পোকার কীড়াগুলো কান্ডের ভেতরে থেকে খাওয়া শুরু করে এবং ধীরে ধীরে গাছের ডিগ পাতার গোড়া খেয়ে কেটে ফেলে। ফলে ডিগ পাতা মারা যায়। একে ‘মরা ডিগ’ বা ‘ডেডহার্ট ’ বলে
মাজরা পোকার আক্রমণ হলে, কান্ডের মধ্যে কীড়া, তার খাওয়ার নিদর্শন ও মল পাওয়া যায়, অথবা কান্ডের বাইরের রং বিবর্ণ হয়ে যায় এবং কীড়া বের হয়ে যাওয়ার ছিদ্র থাকে।
মাজরা পোকার কীড়াগুলো ডিম থেকে ফুটে রেরুবার পর আস্তে আস্তে কান্ডের ভেতরে প্রবেশ করে।
কীড়ার প্রথমাবস্থায় এক একটি ধানের গুছির মধ্যে অনেকগুলো করে গোলাপী ও কালোমাথা মাজরার কীড়া জড়ো হতে দেখা যায়।
কিন্তু হলুদ মাজরা পোকার কীড়া ও পুত্তলীগুলো কান্ডের মধ্যে যে কোন জায়গায় পাওয়া যেতে পারে।
আলোর চার পাশে যদি প্রচুর মাজরা পোকার মথ দেখতে পাওয়া যায় তাহলে বুঝতে হবে ক্ষেতের মধ্যে মথগুলো ডিম পাড়া শুরু করেছে।
ক্ষতির ব্যপ্তিঃ
গবেষণায় দেখা গেছে- ধান ক্ষেতের শতকরা প্রায় ৭০ – ৮০ ভাগ ফসলই নষ্ট হয়ে যেতে পারে, যদি সময়মত মাজরা পোকা দমন না করা যায়।
সাধারণত এই পোকার আক্রমণ চৈত্রের শুরুতে তীব্রতর হয় এবং বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত বিদ্যমান থাকে এরপর আষাঢ়-শ্রাবণে আক্রমণ কমতে থাকে, কিন্তু আশ্বিন-কার্তিক মাসে আবার আক্রমণ বেশ তীব্রতর হয়।
উচ্চ ফলনশীল জাতে এই পোকা বেশি আক্রমণ করে।
অধিক মাত্রায় ইউরিয়া সার প্রয়োগ করলে।
সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১৭-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ধানের সব কয়টি পর্যায়ে যদি তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর বেশি না হয়।
উষ্ণ ও আর্দ্রযুক্ত আবহাওয়া অর্থাৎ ৮০-৯০% আপেক্ষিক আর্দ্রতা এই পোকার সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত।
আক্রান্ত ফসলের নমুনা
জৈবিক ও যান্ত্রিক পদ্ধতিতে দমনঃ
নিয়মিতভাবে ক্ষেত পর্যবেক্ষণের সময় মাজরা পোকার মথ ও ডিম সংগ্রহ করে নষ্ট করে ফেললে মাজরা পোকার সংখ্যা ও ক্ষতি অনেক কমে যায়।
থোর আসার পূর্ব পর্যন্ত হাতজাল দিয়ে মথ ধরে ধ্বংস করা যায়।
মাজরা পোকার পূর্ণ বয়স্ক মথের প্রাদুর্ভাব যখন বেড়ে যায় তখন ধান ক্ষেত থেকে ২০০-৩০০ মিটার দূরে আলোর ফাঁদ বসিয়ে মাজরা পোকার মথ সংগ্রহ করে মেরে ফেলা যায়।
চারা লাগানোর পরপরই জমিতে পর্যাপ্ত পরিমানে ডালপালা বা খুটি পুতে দিন যাতে সেখানে পাখি বসে পোকা খেতে পারে।
মাটি পরীক্ষা করে জমিতে সুষম সার দিন।
রাসায়নিক পদ্ধতিতে দমনঃ
ধানের চারা লাগানোর ১৫ দিন পর- প্রথম কিস্তি ইউরিয়া সার প্রয়োগের সময় ইউরিয়ার সাথে ব্রিফার ৫ জি বিঘা প্রতি ১.৩ কেজি ও সালফক্স ৮০ ডব্লিউ ডি জি বিঘা প্রতি ১ কেজি করে প্রয়োগ করতে হবে। (মাজরা পোকা ও নেমাটোড দমনের জন্য- ব্রিফার ৫ জি এবং গাছের পুষ্টির চাহিদা পূরনের জন্য- সালফক্স ৮০ ডব্লিউ ডি জি)
শীষ আসার পর মাজরা পোকা যাতে ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য চারা লাগানোর ৪০-৪৫ দিন পর- রিলোড ১৮ এস সি ৫ মিলি প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে স্প্রে করতে হবে। একর প্রতি মাত্রা ১০০ মিলি।
এছাড়া মাজরা পোকা দমনের জন্য অন্যান্য কার্যকরি কীটনাশক হল- এসিমিক্স ৫৫ ই সি ১০ মিলি প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে স্প্রে করতে হবে। একর প্রতি মাত্রা ২০০ মিলি।
অথবা ল্যামিক্স ২৪.৭ এস সি ২০ মিলি প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে স্প্রে করতে হবে। একর প্রতি মাত্রা ৪০০ মিলি।
অথবা গোলা ৪৮ ই সি ১০ মিলি প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে স্প্রে করতে হবে। একর প্রতি মাত্রা ২০০ মিলি।
অথবা বেনথিয়াম ৪০ ডব্লিউ ডি জি ২.৫ গ্রাম প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে স্প্রে করতে হবে। একর প্রতি মাত্রা ৫০ গ্রাম।
অথবা গুলি ৩ জি আর প্রতি বিঘাতে ১.৩ কেজি প্রয়োগ করতে হবে। একর প্রতি মাত্রা ৪ কেজি।
অথবা সিডিয়াল ৫ জি প্রতি বিঘাতে ১.৩ কেজি প্রয়োগ করতে হবে। একর প্রতি মাত্রা ৪ কেজি।