সবুজ ধানের অন্যতম শত্রু বাদামী গাছ ফড়িং। এটি কারেন্ট পোকা নামেও পরিচিত।
এগুলোর গায়ের রঙ বাদামী বা গাঁড় বাদামী হয়ে থাকে। পূর্ণবয়স্ক পোকা লম্বা ও খাটো দু’ধরনের হয়ে থাকে।
এগুলোর দেহ খুবই নরম এবং স্ত্রী পোকার পেট পুরুষ অপেক্ষা বেশি বড়। পূর্ণবয়স্ক পোকা ৩.৫ থেকে ৫.০ মিঃ মিঃ লম্বা হয়ে থাকে।
লম্বা পাখা বিশিষ্ট পূর্ণবয়স্ক বাদামী ফড়িং গুলো প্রথমে ধান ক্ষেতে আক্রমণ করে। এরা পাতার খোলে এবং পাতার মধ্য শিরায় ডিম পাড়ে।
ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে ৭ থেকে ৯ দিন সময় লাগে। বাচ্চা গুলো ৫ বার খোলস বদলায় এবং পূর্ণবয়স্ক ফড়িং এ পরিণত হতে ১৩ থেকে ১৫ দিন সময় নেয়।
ক্ষতির ধরণঃ
ডিম ফুটে সাদা রঙের অতিক্ষুদ্র বাচ্চা বের হয়ে পাতার খোল থেকে রস খেয়ে বড় হতে থাকে।
একজোড়া পোকা প্রতিবার প্রায় লক্ষাধিক পোকার জন্ম দিয়ে থাকে। এসব পোকা এক একরের বেশি জমির ফসল নষ্ট করে দিতে সক্ষম।
এ পোকার সংখ্যা এত বেড়ে যায় যে, আক্রান্ত ক্ষেতে বাজ পড়ার মত হপারবার্ন এর সৃষ্টি হয়। দূর থেকে গাছ গুলোকে পুড়ে যাওয়ার মত দেখায়। এ ধরনের ক্ষতিকে “হপার বার্ণ” বলে।
একদিনে তাদের শরীরের ওজনের ১০-২০ গুণ খেতে পারে। অতিরিক্ত খাদ্য গাছের নিচের পাতায় মধু আকারে ঢেলে দেয়। পরে ঐ মধুতে ঝুল ছত্রাক জন্মে। এই ছত্রাক গাছের বৃদ্ধিতে বাধা দেয়।
বাদামী গাছ ফড়িং গ্রাসি স্টান্ট, ব্যাগেট স্টান্ট ও উইল্টেড স্টান্ট নামক ভাইরাস রোগ ছড়ায়।
ক্ষতির ব্যপ্তিঃ
সাধারণত বাদামী গাছ ফড়িং এর আক্রমণে শতকরা প্রায় ৬০ ভাগ ফসল নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এমনকি অনুকূল পরিবেশ পেলে এ পোকার আক্রমণে ক্ষেতে হপার বার্ণ সৃষ্টি হতে পারে, যার ফলে ১০০ ভাগ ফলনই ধ্বংস হয়ে যায়।
বাচ্চা ও পূর্ণবয়স্ক বাদামী গাছ ফড়িং আলো ও বাতাস পছন্দ করে না। তাই গাছের গোড়ায় যেখানে আলো-বাতাস কম অর্থ্যাৎ কান্ডে অবস্থান নেয়। আলো-বাতাস কমসম্পন্ন জমিতে প্রাদুর্ভাব বেশি লক্ষ্য করা যায়।
সাধারণত যখন থোর ও ফুল আসে তখনই ইহার সংখ্যা বাড়তে থাকে। জমিতে ইউরিয়া সার বেশি ও পটাশ সার কম ব্যবহার করা।
জমি সব সময় ভিজা থাকা, বেশি ঘন করে ধান রোপণ, জমিতে আগাছা থাকা ইত্যাদি।
সাধারণত মার্চ মাসে এ পোকার সংখ্যা কম থাকে পরে ধীরে ধীরে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে এপ্রিল- মে মাসে প্রচুর হয়। জুন মাসে আবার এদের সংখ্যা কমতে থাকে এবং সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এ পোকা কম সংখ্যায় থাকে। পূনরায় অক্টোবর মাসে এ পোকার সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। এভাবে নভেম্বর/ডিসেম্বর মাসে এরা আবার সর্বোচ্চ সংখ্যায় হয়ে থাকে।
আক্রান্ত ফসলের নমুনা
জৈবিক ও যান্ত্রিক পদ্ধতিতে দমনঃ
পোকার বংশবৃদ্ধি কম থাকতেই জৈবিক দমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।
আক্রান্ত জমির পানি ৭-৮ দিনের জন্য সরিয়ে ফেলতে হবে।
আক্রমণ প্রবণ এলাকায় প্রতিরোধী জাত যেমন ব্রি ধান-২৮, ৩৩, ৩৫, বিনা ধান-৭ চাষ করা।
ধান গাছ হাত দিয়ে ভাগ-ভাগ করে ফাঁকা করে আলো বাতাসের ব্যবস্থা করে দেওয়া।
আক্রান্ত জমিতে ইউরিয়া সার প্রয়োগ না করা।
আক্রমণ প্রবণ এলাকায় ২৫ সেমি দূরে-দূরে চারা রোপন করতে হবে।
সর্বোপরি আলোর ফাঁদ ব্যাবহার করে জমিতে হাঁস ছেড়ে দেওয়া, ক্ষেতে ডালপালা পুঁতে বা জমিতে উপকারী পোকার আক্রমণ বাড়ানো।
রাসায়নিক পদ্ধতিতে দমনঃ
বাদামী গাছ ফড়িং দমনের জন্য সবচেয়ে কার্যকরি কীটনাশক- পাইরাজিন ৭০ ডব্লিউ ডি জি ৪ গ্রাম প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতক জমিতে স্প্রে করতে হবে। একর প্রতি মাত্রা ৮০ গ্রাম।
এছাড়া বাদামী গাছ ফড়িং দমনের জন্য অন্যান্য কার্যকরি কীটনাশক হল- ল্যামিক্স ২৪.৭ এস সি ২০ মিলি প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে স্প্রে করতে হবে। একর প্রতি মাত্রা ৪০০ মিলি।
অথবা এসিমিক্স ৫৫ ই সি ১০ মিলি প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে স্প্রে করতে হবে। একর প্রতি মাত্রা ২০০ মিলি।
অথবা টিডো ২০ এস এল ২.৫ মি.লি. ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতক জমিতে স্প্রে করতে হবে। একর প্রতি মাত্রা ৫০ মিলি।
অথবা প্লাটিনাম ২০ এস পি ১ গ্রাম প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে স্প্রে করতে হবে। একর প্রতি মাত্রা ২০ গ্রাম।
বাদামী গাছ ফড়িং গাছের গোঁড়ায় থাকে এ জন্য স্প্রে দ্বারা গাছে কীটনাশক ঔষধ ছিটানোর সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যেন গাছের গোঁড়া ভালো ভাবে ভিজে।
যদি কোন সময় ছিটানো ঔষুধ স্প্রে করার পর বৃষ্টিতে ধুয়ে গেলে এক সপ্তাহ পরে পুনরায় গাছে ঔষধ প্রয়োগ করতে হবে।